Sunday 22 December 2013

সাতক্ষীরায় যৌথ অভিযান ও আ’লীগ সন্ত্রাসীদের তান্ডব আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছে

# সেনা ও বিজিবি সদস্যদের বাড়িও জ্বালিয়ে দিয়েছে
# প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে
# পরিকল্পিতভাবে তা-ব চালানো হচ্ছে
# গ্রেফতার এড়াতে মানুষ গা ঢাকা দিচ্ছে
# অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে ২০ লাখ মানুষ
# ঘুমন্ত বাবুলকে ধরে রাস্তায় এনে গুলী করা হয়
আব্দুর রাজ্জাক রানা, সাতক্ষীরা থেকে ফিরে : যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তা-বে সাতক্ষীরা সদর, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও আশাশুনি’র মানুষ আতঙ্কিত ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ১৮ দলের পঞ্চম দফার অবরোধ করতে নেতা-কর্মীরা মাঠে নামলেই যৌথবাহিনী তাদের উপর গুলী করছে। এমনকি বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে থানায় ও রাস্তায় মানুষের সামনেই গুলী করছে। এ দৃশ্য দেখে যাতে ভয় পেয়ে আর কেউ রাজপথে নামতে সাহস না পায় সে জন্য। এখানে দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকসহ কিছুই চলছে না। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নেতাশূন্য করতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি, বৈকারী, কুশখালি, ঘোনা, ঝাউডাঙ্গা, বল্লী, লাবসা, আলীপুর, ভোমরা, বাঁশদহা, ফিংড়ি, কলারোয়ার দেয়াড়া, যুগিখালি, লাঙ্গলঝাড়া, ব্রজাবক্স, তালার কুমিরা, জেয়ালা নলতা, ইসলামকাটি, খলিষখালি, পাটকেলঘাটা, তালা সদর, নগরঘাটা, আশাশুনির বুধহাটা, কুল্যা, প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা, বড়দল, দরগাহপুর, কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর, কৃষ্ণনগর, মৌতলা, ভাড়াশিমলা, নলতা, পাউখালি, সাতপুর, দেবহাটার নারকেলি, সখিপুর, গাজীরহাট, নাংলা, দেবহাটা সদর, গড়ানবাড়িয়া, শ্যামনগরের কাশিমাড়ি, জয়নগর, আটুলিয়া, রমজাননগর, ভেটখালি, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, কৈখালি, ঈশ্বরীপুর, ভুরুলিয়া, খানপুরসহ জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় পরিকল্পিতভাবে তা-ব চালাচ্ছে। এসব এলাকার সাধারণ মানুষও যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরেও অনেকের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করছে। আর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। এসব হামলায় সুন্দরবনের বনদস্যুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। 
এদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও। তারাও রয়েছে চরম আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। সব মিলিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ। জরুরি প্রয়োজনেও কেউ বাইরে বের হতে পারছে না। পুলিশ, এলাকাবাসী ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, রোববার ভোর রাতে যৌথবাহিনীর সদস্যরা কালিগঞ্জ উপজেলায় কুশলিয়া ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে অভিযান চালায়। এ দু’টি ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়িই পুরুষশূন্য থাকায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা গালিগালাজ করে এবং অনেকের বাড়ি ও ঘরের দরজা-জানালা ভাংচুর করে। পরে যৌথবাহিনীর সদস্যরা মুকন্দপুর এলাকার রুহুল আমীনের পুত্র শিবির কর্মী আশরাফুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে রাস্তায় এনে ঠা-া মাথায় পায়ে গুলী করে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুলীবিদ্ধ বাবু’র পিতা রুহুল আমিন দাবি করেন, তার ছেলেকে ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়ি থেকে ধরে এনে পুলিশ গুলী করে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থেকে তিনজন, আশাশুনি উপজেলা থেকে একজন ও কলারোয়া উপজেলা থেকে একজনসহ মোট ছয়জনকে যৌথবাহিনী গ্রেফতার করেছে।
এলাকাবাসী জানায়, শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা মুখোশপড়া আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে অভিযান চালায়। এ সময় তারা উক্ত গ্রামের বাসিন্দা সাতক্ষীরা (সদর পূর্ব) জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা শফিকুল ইসলামের বাড়িতে যায়। তাকে বাড়িতে না পেয়ে যৌথবাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা বুলড্রোজার দিয়ে তার একতলা বিল্ডিং বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তার গোয়ালঘরটিতেও আগুন দেয় তারা। এতে তার কয়েকটি ছাগল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পাশ্ববর্তী জুলফিকারের স্ত্রী নাছিমা জানান, পুলিশ ও আ’লীগের লোকজন তার ঘরে ঢুকে জুলফিকারকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে নাছিমাকে তারা লাঞ্ছিত করে এবং গুলী করে মেরে হুমকি দিয়ে চলে যায়। রাত ১টার দিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আনিছুর রহমানের বাড়িতে যায়। এ সময় তাকে বাড়িতে না পেয়ে তারও বিল্ডিং বাড়িটি যৌথবাহিনী ও আওয়ামী লীগের মুখোশধারী ক্যাডাররা গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তারা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মহিলাদের লক্ষ্য করে পরপর তিন রাউন্ড গুলী করতে আর শ্লোগান দিতে দিতে চলে যায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। একই সময় বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আনিছুর রহমানের ভাই সীমান্ত কলেজের অধ্যক্ষ আজিজুর রহমানের বাড়িটি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। তবে উপস্থিত যৌথবাহিনীর সদস্যরা এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে উত্তেজিত জনতা এসব ভাংচুর করেছে বলে শুনেছি।
এদিকে আশাশুনি উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা শ্রীউলা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুর রহমানের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় তাকে বাড়িতে না পেয়ে বাড়ির আসবাবপত্র ভাংচুর ও মালামাল লুটপাট করে। যাবার সময় তারা জামায়াতের সেক্রেটারির ছেলে মাহবুবকে (২৫) গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বাঁধা দিলে তারা বাড়ির মহিলা ও শিশুদের মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং লাঞ্ছিত করে।
অপরদিকে কালিগঞ্জ উপজেলার কুশলিয়া-বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে যৌথবাহিনী ও যুবলীগ নেতা সাঈদ মেহেদীর বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডারদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সেনাবাহিনী ও বিজেবি’র সদস্যদের বাড়িও। গত ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমান তার বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডাররা শ্রীধরকাটি গ্রামের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর সৈনিক আকরাম হোসেনের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা তার দোতলা বাড়িটি ভাংচুর করে। বাড়ির আসবাবপত্র, ধান-চাল ও কাপড়-চোপড় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এখানে কথা হয় তার বৃদ্ধ পিতা গহর আলী’র সাথে। তিনি এ সময় চোখ মুছতে মুছতে বলেন, কি আর বলবো। আমার বাড়িঘর ভাংচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো তারা। আবার আমার ছেলের নামে মামলাও করলো। এ কোন্্ যুগে বাস করছি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে সিদ্দিকুর রহমান আমার বাড়িটি ভাংচুর করলো আবার মামলাও করলো। যাওয়ার সময় ঘরে অবশিষ্ট চালের মধ্যে বিষ দিয়ে রেখে গেছে। পাশ্ববর্তী কুশলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আব্দুল হামিদের বাড়িতে গত ১৭ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর সদস্য ও সাঈদ মেহেদীর সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা করে। এ সময় তারা তার বাড়ি ভাংচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তার পিতা নিজামউদ্দিন তরফদার বলেন, সাংবাদিকরা লিখে কি করবেন। আমরা তো মানুষ না। আমাদের যে যা পারছে তাই করছে। একই গ্রামের বাসিন্দা বিজিবি’র সিপাই আজিজুল ইসলামের বাড়িতে একই কায়দায় হামলা ও ভাংচুর চালায়। এ সময় তারা তার বাড়ির সকল আসবাবপত্র ভাংচুর করে। তার বৃদ্ধ পিতা সিদ্দিক তরফদার বলেন, আমরা কারোর কাছে এর বিচার চাই না। আল্লাহ তায়ালা এর বিচার করবেন। এর বেশি কিছুই বলতে চাই না।
ভদ্রখালির ষাটোর্ধ্ব নূর আলী গাজী বলেন, আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের কথা শুনেছি, এবার আওয়ামী লীগের লোকজন যেভাবে ধ্বংস লীলা চালিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানিয়েছে। দু’হাত, দু’পা থাকতেও আজ আমার কিছুই নেই। প্রতিবেশীদের দেয়া সাহায্য-সহযোগিতার উপরই বেঁচে থাকলেও এই শীতের মধ্যে ঘুমানোর স্থানটুকুও নেই। পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা সামছুর রহমান গাজী হাই তুলে বললেন, ওরা ঘোষণা দিয়েছে, জামায়াত-বিএনপি সমূলে নির্মূল করবে। তাই গ্রামের পর গ্রাম আগুন, ভাংচুর চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বিধবা মহিলারাও। যৌথবাহিনী রয়েছে পাহারাদার হিসেবে। স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া ওদের দমন করা সম্ভব নয়। এখান থেকে একটু সামনে যেতেই সামনে এসে হাউমাউ করে পড়ে বেলায়েত আলী মোড়ল, হাফিজুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান গাজী, মাওলানা আব্দুর রহমান, আব্দুল গফুর, ক্বারী মোসলেম উদ্দিন, আমির আলী গাজী, মোকছেদ আলীর স্ত্রী নূরুন্নেছা। তারা সাংবাদিক পরিচয় শুনেই বলেন, ঢাকা থেকে বড় সাংবাদিকরা এসে মাইকে ঘোষণা দিয়েছেন, জামায়াত-শিবির দেশে থাকতে পারবে না। আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন, আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবো। জন্মস্থানে কি আমাদের থাকার কোন জায়গা হবে না। এ কথা বলে সবাই অঝরে কেঁদে ফেললেন। পাশের গ্রাম গোবিন্দপুরে গেলে কথা হয় আব্দুর রাশেদ, আব্দুল জব্বার ও আব্দুস সবুরের সাথে। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। তারা আমাদের কাছে জানতে চায়, আজ রাতেও নাকি যৌথবাহিনী ও আওয়ামী লীগ আসবে। ওরা তো গ্রামের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমরা কোথায় যাবো। এ সময় পাশে দাঁড়ানো আমিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাচ্চাদের রাতে ঘুম পাড়ানোর জন্য মায়েরা বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়, আওয়ামী লীগ আসছে। আতঙ্কে বাচ্চারা সবাই চোখ বন্ধ করে। এবার বুঝছেন, আমরা কোন অবস্থার মধ্যে আছি। আপনাদের সাথে কথা বলছি, এ খবর ওদের কাছে চলে গেলে। রাতে নাকি ওরা আবার আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ডা: শহিদুল আলম জানান, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে সরকার সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। তারা কালিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি নুর মোহাম্মদের বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীরদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করেছে।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী আযম খান বলেন, কুশলিয়া ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে সহিংস ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭/৮টি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ রোববার পুলিশের সঙ্গে শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় এসআই নকীব অয়জুল হক বাদি হয়ে আট জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় শিবিরকর্মী আশরাফুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর জানান, যৌথবাহিনীর চিরুনী অভিযানে গত ২১ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী।

No comments:

Post a Comment