Saturday 26 October 2013

বসুন্ধরার নজিরবিহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতি মন্ত্রী-সচিবদের হাজার কোটি টাকার ঘুষ কেলেংকারি

শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে : দুই মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কর্মকর্তাদের বড় অংকের লেনদেনের বিনিময়ে বসুন্ধরা গ্রুপ নজিরবিহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এসব অনিয়মকে কেন্দ্র করে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানসহ আরও এক মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সচিব, রাজউক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা পরস্পর আর্থিক লাভবান হয়ে ড্যাপ উপ-কমিটির সভায় বসুন্ধরাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অনুমোদন দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলে জানা গেছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকারের যেটুকু ভাবমূর্তি আছে তাও ভূলুণ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একটি চিহ্নিত মহল ভয়াবহ এই দুর্নীতি ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। যারা ব্যক্তি স্বার্থে রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার জন্য এমন কাজ করেছেন; তারা সরকার ও জনগণের চরম ক্ষতি করেছেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে বসুন্ধরাকে অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোন নিয়ম-কানুন, ডিএমডিপি ও ড্যাপের সমীক্ষা, নকশা, পরিবেশ ও জলাধার আইনসহ কোন কিছুই মানা হয়নি। শুধু কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে মন্ত্রী-সচিবদের ম্যানেজ করে বসুন্ধরা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে অনুমোদন করিয়ে ৪ হাজার ৩০২ বিঘা (প্রায় ৮৬ হাজার ৪০ কাঠা) জমি অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চাইছে
 রাজধানীর জোয়ারসাহারা ও কাঁঠালদিয়া মৌজার এসব জমি বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকায় কাঠা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কাঠা জমির গড় মূল্য ন্যূনতম ৫০ লাখ টাকা ধরলেও জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া বসুন্ধরার এই সম্পত্তির দাম প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর এক কোটি টাকা কাঠা দামে ওই জমি বিক্রি হলে ৮৬ হাজার কাঠার মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা। বেআইনিভাবে অনুমোদন করিয়ে নেয়া এই জমির মধ্যে সরকারের খাস, নালা ও নদী-খালসহ জমি রয়েছে ৮০০ একর (২ হাজার ৪০০ বিঘা) এবং ভাওয়াল রাজ এস্টেটের জমির পরিমাণ ২১৬ একর (৬৭৮ বিঘা).... বসুন্ধরার দখলকৃত সরকারি ও ভাওয়াল এস্টেটের জমি উদ্ধারে ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত থাকলেও উল্লিখিত উপ-কমিটি নিজেদের স্বার্থে এসবের পাত্তা না দিয়ে এক তরফাভাবে বসুন্ধরাকে অনুমোদন দিয়েছে।


শুধু তাই নয়, ওই উপকমিটির সভায় হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তারা বসুন্ধরার আবাসিক এলাকার ‘ই’ ব্লক থেকে ‘কে’ ব্লক পর্যন্ত অনুমোদন দিলেও এখন  কৌশলে ওই সভার সিদ্ধান্তে জালিয়াতির মাধ্যমে ‘এল’ ব্লক থেকে ‘পি’ ব্লক পর্যন্ত লিখিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় যেসব জমি দেখানো হয়েছে তাতে সরকারি এই জমি এবং নদী-নালা ছাড়াও অন্যান্য জমির বেশিরভাগেরই মালিক বসুন্ধরা নয়, অন্য সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের জমি জবরদখলের চেষ্টা করছে। সরকারি-বেসরকারি এসব জমি, জলাশয়, নদী-নালা জবরদখল করে ড্যাপ উপকমিটির মাধ্যমে জায়েজ করে তা বিক্রির মাধ্যমে বিশাল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ মরিয়া হয়ে উঠেছে। অফিসিয়াল অনুমোদনের জন্য কার্যবিবরণীর ফাইলটি এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভূমিমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এতে স্বাক্ষর করলেই বসুন্ধরা গ্রুপ অবৈধ পন্থায় কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে। আর এ কারণেই মন্ত্রী-সচিবদের ম্যানেজ করার কাজে হাজার কোটি টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করছে না তারা।   এছাড়া, উপকমিটির সুপারিশ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যে ক’টি আবাসন প্রকল্প তাদের প্রস্তাব রিভিউ করার আবেদন দিয়েছে তাদের মধ্যে শুধু বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্প ছাড়া অন্য কোন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়নি। অন্যান্য প্রকল্পসমূহের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক পানি সংরক্ষণের স্থান বা রিটেনশন প- হওয়ায় অনুমোদন দেয়া যাবে না।

 অথচ যে প্রকল্পটি রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম দায়ী সেই বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্পের রিটেনশন পন্ড হিসেবে চিহ্নিত ব্লকগুলোতে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক, পরিবেশ অধিদফতর, ওয়াসা ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী এমন স্বার্থে ডিএমডিপি ও ড্যাপের বন্যা প্রবাহ এলাকা, সংরক্ষিত জলাধার, নিচু জমি ও জলাশয় এবং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় বসুন্ধরাকে হাউজিংয়ের অনুমোদন দেয়ার ব্যবস্থা করলেন? সরকারের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে এবং ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বসুন্ধরার ভেতরের ৩ হাজার ৭৮ বিঘা সরকারের জমি উদ্ধারের কোন প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন? উপকমিটির সভায় কোন কোন সদস্য ড্যাপের সমীক্ষা ও নকশা অমান্য করে এভাবে অনুমোদনের বিরোধিতা করলেও কেন তা মানা হলো না? তাছাড়া উপ-কমিটির সভার কার্যবিবরণী জালিয়াতি করে ‘ই’ ও ‘কে’ ব্লকের স্থলে ‘এল’ ও ‘পি’ ব্লকের কথা লিখে পাস করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হলেও কেন মন্ত্রী ও সচিবরা চুপচাপ তা অনুমোদন করে দিচ্ছেন? এসবই কী প্রমাণ করে না যে, বসুন্ধরার কাছ থেকে হাজার কোটি টাকার বিনিময়েই তারা বসুন্ধরাকে উল্লেখিত সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন? শুধুমাত্র বসুন্ধরার মালিককে বিশেষ সুবিধা দিতে প্রভাবশালী মহলটি পারস্পরিক যোগসাজশ করে এমন বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?


সর্বকালের সর্ববৃহৎ জালিয়াতি ও প্রতারণা
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে এমন ভয়াবহ দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা আর ঘটেনি। ইতিমধ্যেই গোপন এই জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় গোটা প্রশাসন জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায়, ড্যাপ পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনার জন্য ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরাকে আহ্বায়ক করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতর ও ওয়াসার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড্যাপ রিভিউ করার জন্য যারা এই কমিটির কাছে আবেদন করেন, তাদের আবেদন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব এই কমিটির। গত সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ ছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আবেদন বিবেচনার দিন। সভায় বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের ১৫টি, বিশেষ প্রস্তাব ৯টি ও ব্যক্তি পর্যায়ের আরও ৫৪টি প্রস্তাব আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে বৈঠকের শুরুতে প্রথমে বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, বসুন্ধরা পদে পদে ড্যাপের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। ড্যাপে যেসব স্থানে জলাধার ছিল তার প্রায় সবই তারা রাতারাতি ভরাট করছে।

 এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কুড়িল বিশ্বরোডের পয়েন্ট থেকে রাজউকের পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পে যাওয়ার জন্য যে ৩শ’ ফুট রাস্তা করা হয়েছে তার দু’পাশে পানি সংরক্ষণ ও চলাচলের জন্য ১০০ ফুট চওড়ার দু’টি খাল খননের জায়গা রাখার কথা ছিল। কিন্তু কোন জায়গা এখানে রাখা হয়নি। দক্ষিণ পাশে একেবারে রাস্তা ঘেঁষে বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ প্রকল্প করা হয়েছে। উত্তর পাশে কিছু জায়গা থাকলেও সেখানে বসুন্ধরার জায়গা রয়েছে যৎ সামান্য। এ অবস্থায় আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও এই অঞ্চলের উপরিভাগের পানি সরানোর কোন সুযোগ থাকবে না। এতে করে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।ড্যাপ সাব কমিটির এই সভায় কমিটির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য উত্থাপন করেন যে, বসুন্ধরার আবেদনে উল্লিখিত মৌজা ডিএমডিপি ও ড্যাপের নকশা এবং সমীক্ষায় বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, সংরক্ষিত জলাধার, নিচু জমি বা জলাশয় এবং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা রয়েছে। তাই এখানে কোন আবাসিক এলাকার অনুমোদন দেয়া যায় না। কিন্তু সভায় এসব বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর বিশেষ প্রভাবে ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘ই’ থেকে ‘কে’ ব্লক পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সময় ১১টি শর্ত জুড়ে দেয়া হলেও বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে ড্যাপের নকশা ও সমীক্ষায় উল্লেখিত কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট রাস্তার দু’পাশের ১০০ ফুট করে দুইটি খাল খননের সিদ্ধান্তকেও প্রভাব খাটিয়ে পাল্টিয়ে দেয়। তারা নিজেদের সুবিধামত রাস্তার দক্ষিণে খাল না রেখে (যেহেতু দক্ষিণে বসুন্ধরার জমি ও হাউজিং প্রকল্প) শুধুমাত্র উত্তর পাশে রাজউক ও বসুন্ধরা মিলে ১০০ ফুট খাল খননের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পূর্বাচল রাস্তার দু’পাশের দু’টি খাল খনন না করা হলে, তা হবে আত্মঘাতী এবং ঢাকার মধ্যাঞ্চল বন্যার পানিতে ডুবে যাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে কতিপয় নীতি-নির্ধারক ও স্বার্থান্বেষী শীর্ষ আমলা ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে একতরফাভাবে বসুন্ধরার এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।


 যা ২০ অক্টোবর রোববার এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ভূমিমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলো।অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপকর্ম শুধু এখানে নয়, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মোটা অংকের গোপন ‘প্যাকেজ’ ডিলের মাধ্যমে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ সেদিনের সভার ওইসব সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করে জালিয়াতির মাধ্যমে কার্যবিবরণীতে ‘ই’ থেকে ‘কে’ ব্লকের সঙ্গে ‘এল’ থেকে ‘পি’ ব্লক পর্যন্ত অনুমোদন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। বসুন্ধরার কাছে কোটি কোটি টাকায় ম্যানেজ হয়ে ইতিমধ্যেই ওই জালিয়াতি সম্বলিত সভার কার্যবিবরণী (‘এল’ থেকে ‘পি’ ব্লক) পূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও সচিব অনুমোদনও করেছেন বলে দাবি করেছে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পূর্বদিকে বালু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত নিচু জলাধার, সরকারি খাস জমি, নালা, খাল, ছোট নদী, সংরক্ষিত জলাধার, বন্যা প্রবাহ এলাকা, জলাশয় এবং ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসহ সবকিছুই বসুন্ধরা জালিয়াতি করে কৌশলে অনুমোদন করে নিয়েছে। অথচ ওই সব কমিটির কাছে আরও অনেক হাউজিং প্রকল্পের আবেদন থাকলেও কমিটি আর কাউকে অনুমোদন দেয়নি। কারণ, তারা কেউই বসুন্ধরার মত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।অথচ গত ১৯ জুন ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়ে যে, ইস্ট-ওয়েস্ট প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্টের বসুন্ধরার আবাসিক প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জোয়ারসাহারা ছাড়াও আরও ব্যাপকভাবে নদ-নদী ও সরকারি সম্পত্তি দখল করেছে।

সরকারের ভূমি সংস্কার কমিশনের অধীনস্থ কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ভাওয়াল রাজা এস্টেটেরও ২১৬ একর (৬৭৮ বিঘা) জমি জবর দখল করে বসুন্ধরা প্লট তৈরি ও বিক্রি করেছে। কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বসুন্ধরার দখলকৃত জমি উদ্ধারের জন্যও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সভায় ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা উপস্থিত থাকলেও ড্যাপ উপ-কমিটির সভায় বসুন্ধরাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ‘ই’ থেকে ‘কে’ ব্লক পর্যন্ত আবাসিক প্রকল্পের জন্য অনুমোদন দেয়ার সময় তিনি বরং অনুমোদনের পক্ষেই প্রভাব খাটিয়েছেন। কী এমন স্বার্থ ছিল এর পেছনে?


বৈষম্যের নমুনা
ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা উপকমিটির পরবর্তী ও শেষ সভা বসে গত ১১ সেপ্টেম্বর। এ সভায় প্রথমে আবাসন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৭টি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু রাজউকের পক্ষ থেকে প্রতিটি প্রকল্পকে জলাভূমি ও ওয়াটার বডি, ওয়াটার রিটেনশন এরিয়া ও ফ্লাড ফ্লো জোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এসব কারণে প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ আবাসিক এলাকা হিসেবে অনুমোদন করা যাবে না বলে মত দেয়া হয়। রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) নেতিবাচক মতামত দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সভায় প্রস্তাবগুলো অনুমোদিত হয়নি। এছাড়া সভায় বিশেষ ১০টি প্রস্তাবের মধ্যে ১টি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের ৫৩টি আবেদনের মধ্যে ৬টি অনুমোদন দেয়া হয়।সচেতন মহল মনে করেন, রাজধানীর বর্তমান জলাবদ্ধতার জন্য অনেকাংশে দায়ী বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্প। কেননা, বসুন্ধরা আবাসন প্রকল্পটি যেখানে গড়ে উঠেছে সেখানকার বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে ছিল পানি সংরক্ষণের ছোট বড় বহু জলাধার। এই প্রকল্পের বেশিরভাগ জায়গায় সারাবছর ৪/৫ ফুট এবং বর্ষাকালে ১০/১৫ ফুট পর্যন্ত পানি থাকতো। অথচ তা ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার কারণে রাজধানীর পানি নিচের দিকে নেমে যেতে পারছে না। উপরন্তু, ড্যাপে নির্ধারণ করা খালের জায়গাও দখলে নিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। রাজধানীতে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষকে জলাবদ্ধতার আশংকার মধ্যে ফেলে দিয়ে এমন বিতর্কিত প্রকল্প ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করেছে। অথচ রাজধানীর বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা পশ্চিমদিকের কৃষি এলাকার উঁচু-নিচু জমিতে আবাসন প্রকল্প করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি।


গোপন বৈঠক  
নিজের প্রস্তাব অনুযায়ী ড্যাপ উপ-কমিটির সুপারিশ চূড়ান্ত করতে বসুন্ধরার চেয়ারম্যান শাহ আলম পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের সঙ্গে তার দফতরে ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার প্রথম বৈঠক করেন। এরপর দ্বিতীয় বৈঠক করেন ২ অক্টোবর। জানা গেছে, সচিব ড. শওকতই মূলত এইসব অনিয়ম-দুর্নীতির নাটের গুরু। ড্যাপ উপ-কমিটির বৈঠকে অবৈধভাবে বসুন্ধরার প্রকল্প অনুমোদনের ব্যাপারে তিনিই সবচে’ বেশি ভূমিকা পালন করেছেন। বৈঠকের কার্যবিবরণীর ফাইল জালিয়াতি এবং উপস্থাপন থেকে শুরু করে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে তার। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ড. শওকত যখন পূর্ত সচিব পদে নিয়োগ পাবার জন্য চেষ্টা করছিলেন তাতে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগিতা ছিলো। বসুন্ধরা গ্রুপ সরকারের মধ্যে তাদের চ্যানেলে ব্যাপক তদবির চালিয়ে এই পদে ড. শওকতের নিয়োগ নিশ্চিত করে। তিনি ভারপ্রাপ্ত পূর্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পাবার পর তার সম্মানে বারিধারাস্থ বসুন্ধরা অফিসে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিলো। সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে তখন এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিলো।ড্যাপের খসড়া কার্যবিবরণী ২৪ সেপ্টেম্বর রাজউক থেকে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে আসে। এরপর সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী উপপ্রধান জালাল আহমেদ ও সিনিয়র সহকারী প্রধান মোসাদ্দেক প্রায় এক সপ্তাহ যাবত এ বিষয়ে কাজ করে খসড়া কার্যবিবরণী চূড়ান্ত করেন। এই চক্রটি জালিয়াতি করে এমন বিষয় কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করে যা সাব-কমিটির বৈঠকে আলোচনাই হয়নি। চরম দুর্নীতি ও জালিয়াতিযুক্ত এই কার্যবিবরণীটি বর্তমানে ভূমিমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।


যেভাবে বসুন্ধরা সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে
রাজধানীর জোয়ারসাহারা মৌজায় ইস্ট-ওয়েস্ট প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লিমিটেড বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্প নামে এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালের ১৩ অক্টোবর এবং ১৯৯০ সালের ৩০ জুলাই ও ২৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে ৩০৫ একর জমির অনুমোদন দেয় রাজউক। এ সময় ‘এ, বি, সি, ডি (আংশিক), ই ও এফ (আংশিক) ব্লকের অনুমোদন নিয়েই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় বসুন্ধরা। তারা ওই সময়ে ৩০৫ একর জমির অনুমোদন নিলেও বিগত ২৫ বছরে কমপক্ষে ৭ হাজার একর জমিতে সরকারের বিনা অনুমতিতে হাউজিং প্রকল্প সম্প্রসারণ করেছে। এই সময় তারা নালা, খাল, নদী ও সরকারি খাস ৮০০ একর জমিও দখল করে নেয়। একইভাবে বসুন্ধরা দখল করে নেয় ভাওয়াল এস্টেটের (কোর্ট অব ওয়ার্ডস) ২১৬ একর জমিও। সাধারণ মানুষের জমিও জবরদখল করেছে। কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য বহুতল ভবন নির্মাণ করে পৃথক সা¤্রাজ্য গড়ে তুললেও তারা আজও পর্যন্ত এগুলো নিয়ম অনযায়ী সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেনি। বেসরকারি হাউজিং নীতিমালা এবং সরকারের সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণ আইন ভঙ্গ করে বসুন্ধরা তাদের আবাসিক এলাকায় সরকারের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও নিরাপত্তা সুবিধা গ্রহণ করলেও সরকার এখান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শ’ শ’ কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে। এখানেও চলছে কানামাছি খেলা।


বসুন্ধরার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে সিটি করপোরেশনও আইন প্রয়োগে তৎপর হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর শুধু বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্প থেকেই সরকার হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ বঞ্চিত হচ্ছে কমপক্ষে শত কোটি টাকা। আর এই সুযোগে বসুন্ধরা তাদের সাম্রাজ্যে গড়ে তুলেছে জুলুম অত্যাচারের এক নজিরবিহীন কর্মপদ্ধতি। সেখানকার সকল বাসিন্দাদের বসুন্ধরার ইচ্ছা অনুযায়ী গুণতে হচ্ছে নিরাপত্তা বিল, পানির বিল, বাড়ি তৈরির ফি, নির্মাণ সামগ্রী আনা-নেয়ার ফি, ডিশ লাইন সংযোগ ফিসহ অসংখ্য নামে বে-নামের লাখ লাখ টাকার বিল।


বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ও সংরক্ষিত জলাধার
সরকার তথা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় রাজউকের উদ্যোগে প্রকাশিত ডিএমডিপি (ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান) ও ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান) ১৯৯৫-২০১৫ এর ম্যাপ এবং সমীক্ষায় জোয়ারসাহারা এবং কাঁঠালদিয়া মৌজার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাটিকে ফ্ল্যাড ফ্লো জোন (বন্যা প্রবণ এলাকা), রিটেনশন পন্ড (সংরক্ষিত জলাধার), ওয়াটার বডি (জলাধার) এবং আর্থ কোয়াক জোন (ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকার জেলা প্রশাসক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ৮০০ একর সরকারি খাস খাল, নালা ও নদী এবং ২১৬ একর ভাওয়াল এস্টেটের জমি রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ সরকারের এসব রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সকল মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০১২ সালে রাজউক থেকে কতিপয় শর্তে ১৪৩৪ একর (৪৩০২ বিঘা বা ৮৬ হাজার ৪০ কাঠা) জমিতে হাউজিং প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে রাজউক যখন বসুন্ধরাকে এই প্রকল্পের শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেয়, তখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান প্রভাব খাটান বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে রাজউকের কিছুই করার ছিল না বলেও সূত্রটি জানায়। এ সময় রাজউক প্রাথমিক অনুমোদনের এক বছরের মধ্যে প্রকল্পভুক্ত শতভাগ জমির মালিকানা দলিল, ড্যাপের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ লে-আউট প্ল্যান, সকল জমির সাব কবলা দলিল (আমমোক্তার নামা, বায়না, হেবা ও দানপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না), মালিকানা নিয়ে সকল বিরোধের নিষ্পত্তি এবং প্রকল্পের মধ্যে জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দেয়।

কিন্তু বসুন্ধরা এসব শর্তের একটিও বিগত এক বছরে পূরণ করতে পারেনি।নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, তারা রাজউকে অল্প কিছু বায়না, আমমোক্তার নামা ও হেবা দলিলসহ কাগজপত্র দাখিল করলেও রাজউক তা গ্রহণ করেনি, যেহেতু আইন অনুযায়ী এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। গত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে সরকারি খাস জমি ও ভাওয়াল এস্টেটের জমি উদ্ধার করার জন্য গণপূর্ত এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধও করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বন্যা প্রবাহ অঞ্চল, সংরক্ষিত জলাধার, জলাশয় এবং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় ডিএমডিপি ও ড্যাপ উপেক্ষা করে আবাসিক প্রকল্পের অনুমোদনের বিরোধিতা করে ইতিপূর্বে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলো বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ও পরিবেশ আন্দোলন (পবা)সহ ৫টি পরিবেশবাদী সংগঠন। কিন্তু এখন টাকার কাছে সবই চুপসে গেছে।
http://www.sheershanews.com/2013/10/26/8762

No comments:

Post a Comment