Thursday 3 October 2013

বেপরোয়া দুর্নীতির উপাখ্যান- ৩ : মহাজোটের লাইসেন্স রাজ : দলীয়ভাবে ব্যাংক-বীমা, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, রেডিও-টিভি ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার কাহিনী

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুর্নীতির উপাখ্যানে ব্যাংক, বীমা, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, প্রাইভেট টেলিভিশন-রেডিও এবং টেলিকম ব্যবসা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার ঘটনাও নজির সৃষ্টি করেছে। এক কথায় বলতে গেলে একে বলা যাবে, মহাজোটের লাইসেন্সরাজত্ব কিংবা লাইসেন্সবাজির হরির লুট।
মহাজোট সরকারের পুরো মেয়াদে ৯টি বেসরকারি ব্যাংক, ১১টি বীমা কোম্পানি, ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১২টি বেসরকারি টেলিভিশন, ২১টি বেসরকারি রেডিও, ৭৮টি টেলিকম লাইসেন্স এবং ২৪টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা, এমপি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, শিল্পী ও সাংবাদিকদের। মহাজোটের শরিকরাও এই ভাগবাটোয়ারার অংশ পেয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ বলয়ের বাইরের কাউকে এসব লাইসেন্সের ধারে-কাছে আসতে দেয়া হয়নি। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন বলা যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। তিনি যেমন ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন। একইভাবে ব্যাংক ও টেলিভিশনের লাইসেন্স পেয়েছেন মহাজোটের শরিক জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও নিজ নির্বাচনী এলাকায় অনুমোদন নিয়েছেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় ফজলে নূর তাপস এমপি নিয়েছেন ব্যাংকের লাইসেন্স। ঠিকাদারি লাইসেন্স ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাইরে বলা যায় কেউই পায়নি। বৈধ ঠিকাদারদের ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের কাছ থেকে বেশি টাকায় কিনে কাজ করতে হচ্ছে। লুটপাটের এমন রাজত্ব আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলকেও হার মানিয়েছে।

দলীয় বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক
মহাজোট সরকার দলীয় বিবেচনায় ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। নতুন ৯টি ব্যাংকের জন্য যারা অনুমোদন পেয়েছেন, তাদের সবাই মহাজোটের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দ্যা ফারমার্স ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি মন্ত্রী হওয়ায় বর্তমানে এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছেন তার স্ত্রী ড. সেতারা আলমগীর।
মধুমতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির। এ ব্যাংকের পরিচালক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি।
মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ. এন. আশেকুর রহমান এমপি। এ ব্যাংকে আওয়ামী লীগ নেতা ও রিহ্যাবের সভাপতি নসরুল হামিদ এমপির ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস.এম. আমজাদ হোসেন। আমজাদ হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তিনি এলাকায় শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল এমপির (বাগেরহাট-১) ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এ ব্যাংকের পরিচালক আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ও খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। এ ব্যাংকটির অনুমোদনে আরও কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান।
মিডল্যান্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয়কর উপদেষ্টা এম. মনিরুজ্জামান।
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদুল আলম। এ ব্যাংকটি অনুমোদনের সময় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মহাজোট নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপির ১০ শতাংশ শেয়ার ছিল। যদিও বর্তমানে চট্টগ্রামের এস. আলম গ্রুপ ব্যাংকটি কিনে নিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে বেশি ব্যাংকিং সুবিধা ভোগ করছে।
প্রবাসীদের কল্যাণে তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা সীমার্ক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম চৌধুরী।
উল্লেখ্য, নতুন একটি ব্যাংক অনুমোদনের জন্য চারশ’ কোটি টাকা মূলধন জমা দিতে হয়েছে। মহাজোটের মন্ত্রী, নেতা যারা এ ব্যাংক পেয়েছেন, তারা সেটা দেখিয়েই এ অনুমোদন নিয়েছেন। লুটপাট দুর্নীতি যে কী হারে হয়েছে, তা এই ৪০০ কোটি টাকার মূলধন জমা দেয়ার মাধ্যমে সহজেই অনুমেয়। নতুন ৯টি ব্যাংক অনুমোদনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই শাসনামলে (৮ বছরে) ২৩টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হলো। আর বিএনপির দুই শাসনামলে (১০ বছরে) নতুন ব্যাংক দেয়া হয় ৮টি।

বীমা কোম্পানির লাইসেন্স পেয়েছেন যারা
দলীয় বিবেচনায় নতুন ১১টি বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দিয়েছে মহাজোট সরকার। এর মধ্যে ৯টি জীবন বীমা কোম্পানি এবং দুটি সাধারণ বীমা কোম্পানি। নতুন এই লাইসেন্স দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, আঞ্চলিক ও বিদেশ শাখার নেতা এবং দলের সমর্থক সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের।
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অন্যতম উদ্যোক্তা রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। এই কোম্পানিতে রূপালী ইন্স্যুরেন্সেরও মালিকানা রয়েছে। সম্প্রতি রূপালী ইন্স্যুরেন্সের ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী প্রধান অতিথিও হন। চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন সংসদের চিফ হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ। ইউনিক হোটেলের প্রতিনিধি হিসেবে এই বীমা কোম্পানিতে আরও আছেন আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী নূর আলী।
আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের এমপি ফরিদুন্নাহার লাইলী পেয়েছেন জেনিথ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম. নাসির উদ্দিন নতুন অনুমোদন পাওয়া মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা। গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তারা হচ্ছে ব্র্যাক ফাউন্ডেশন, আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, স্কয়ার গ্রুপ এবং একে গ্রুপ। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও স্যামুয়েল এইচ চৌধুরীর নাম।
বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা মেজর জেনারেল (অব.) হাফিজ মল্লিক। মোশাররফ হোসেন নামক একজন হিসাববিজ্ঞানী এই কোম্পানির পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে তিনি একজন ঋণখেলাপি।
প্রটেকটিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম। পরিচালক রয়েছেন চট্টগ্রামভিত্তিক ক্রিস্টাল গ্রুপের মালিক ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোরশেদ মোরাদ ইব্রাহীমের ভাই রাশেদ মোরাদ ইব্রাহীম এবং ফুটবল ও ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফত।
জাপানি কোম্পানি তাইও এবং স্থানীয় সামিট গ্রুপকে যৌথভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাইও-সামিট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নামে। সামিট গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান এবং এশিয়ান ফার্নিচারের মালিকানা রয়েছে এতে।
এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে কানাডা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আহাদকে। এতে পরিচালক রয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা মোস্তফা আজাদ চৌধুরী ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুল বারী চৌধুরী।
নতুন অনুমোদন পাওয়া দুটি সাধারণ বীমা কোম্পানির মধ্যে একটিতে মালিকানা রয়েছে শিকদার গ্রুপের। মমতাজুল হক শিকদার ও জয়নুল হক শিকদারের পাশাপাশি মিরপুরের এমপি আসলামুল হক এবং মেজর জেনারেল (অব.) বিজয় কুমার সরকার এই কোম্পানির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। অন্যটি হচ্ছে সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বর্তমানে ৪২টি সাধারণ বীমা কোম্পানি রয়েছে। জীবন বীমা কোম্পানি রয়েছে ১৭টি। মেটলাইফ অ্যালিকো নামে রয়েছে একটি বিদেশি জীবন বীমা কোম্পানি। এর বাইরে সরকারি সংস্থা রয়েছে দুটি—সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবন বীমা করপোরেশন।
দেশে যে কোম্পানিগুলোকে আগের বারের আওয়ামী লীগ সরকার লাইসেন্স দিয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগেরই অবস্থা এখন খারাপ। তেমন কোনো ব্যবসা নেই। কোনো সুশাসনও নেই এগুলোতে। দেড় যুগ আগে লাইসেন্স পাওয়া বীমা কোম্পানির বেশিরভাগই নামকাওয়াস্তে টিকে আছে। বেশ কয়েকটি সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো পরিস্থিতি রয়েছে বলে এর আগে মত দিয়েছিল ইনস্যুরেন্স নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইডিআরএ।

দলীয় বিবেচনায় ২৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন
দলীয় বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ক্ষেত্রেও নজির সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার। গত পাঁচ বছরে চার দফায় ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় দেয়া হয়েছে সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা, সরকার দলীয় এমপি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা এবং সিটি করপোরেশনের সরকার দলীয় সাবেক মেয়রের নামে। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছেন। শিক্ষা সচিবের নামেও বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নতুন এই ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দেশে বেসরকারি-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৭৭টি।
অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মিরপুর শাহ আলীবাগে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের শর্ত পূরণ করতে না পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সিলেটের গোলাপগঞ্জের নিজ নির্বাচনী এলাকায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী নুরূল ইসলাম নাহিদের বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। এর মূল উদ্যোক্তা চিকিত্সক আফজাল মিয়াকে দেখানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যায়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ চৌধুরীকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৃত মালিক শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ। রাজশাহীর মতিহারে অবস্থিত বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্যোক্তা হাফিজুর রহমান খানকে দেখানো হলেও মূল মালিকানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখরের। ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ চুয়াডাঙ্গার পৌর কলেজপাড়ায়। এর মূল উদ্যোক্তা সরকারদলীয় এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দার।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় অনুমোদন পেয়েছে ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এর পেছনে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক দুর্গাদাস ভট্টাচার্য। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কার্তিকপুরের মধুপুর এলাকায় অনুমোদন পেয়েছে জেডএইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি। এর পেছনে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। এই ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম। সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটি প্রথমে মধ্য বাড্ডায় অবস্থান বলা হলেও পরে কারওয়ানবাজারের ঠিকানা দেয়া হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান এমপি নজরুল ইসলাম বাবু।
ফেনী ইউনিভার্সিটি ফেনীর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুস সাত্তারের নাম থাকলেও এর পেছনে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন সহকারী একান্ত সচিব ও সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত। খুলনার সোনাডাঙ্গার ১১৮ মজিদ সরণিতে নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা খুলনার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আবদুল খালেক। চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা হলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম। ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে এ এম মোজাহারুল ইসলাম হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল উদ্যোক্তা হলেন শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
একইভাবে অন্যগুলোরও উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যক্তিরাই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগই শর্ত পূরণ করেনি, দলীয় বিবেচনায়ই অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন না দেয়ার সুপারিশ করা সত্ত্বেও মহাজোট সরকার দলীয় লোকদের ২৬টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে।

দলীয় বিবেচনায় ২৪টি মেডিকেল কলেজ
মহাজোট সরকার দলীয় বিবেচনায় ২৪টি মেডিকেল কলেজেরও অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, অথচ একের পর এক মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়। দলীয় চিকিত্সক এবং ব্যবসায়ীরা এসব অনুমোদন পেয়েছেন।

দলীয় বিবেচনায় ১২টি টিভি ও ২১টি রেডিও
মহাজোট সরকার এ পর্যন্ত দলীয় বিবেচনায় ১২টি বেসরকারি টেলিভিশন ও ২১টি রেডিওর অনুমোদন দিয়েছে। রেডিওর মধ্যে এফএম রেডিও স্থাপন ও সম্প্রচারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৭টি এবং কমিউনিটি রেডিও দেয়া হয়েছে ১৪টি। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন অনুমোদনের ক্ষেত্রে। অনেক টেলিভিশনের মালিকই সাংবাদিক নন।
যে ১২টি বেসরকারি টিলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী একে আজাদের চ্যানেল টুয়েন্টিফোর, এনায়েতুর রহমানের চ্যানেল নাইন, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সময় টেলিভিশন, কট্টর আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবুর একাত্তর টেলিভিশন, সরকালি দলীয় এমপি কামাল মজুমদারের মোহনা টেলিভিশন, স্কয়ার গ্রুপের অঞ্জন চৌধুরীর মাছরাঙা টেলিভিশন, আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, এটিএন বাংলার মাহফুজুর রহমানের এটিএন নিউজ, গাজী গ্রুপের মালিক গোলাম দস্তগীর এমপির গাজী টেলিভিশন, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী নাসির উদ্দীন সাথীর মাইটিভি, এসএ পরিবহনের মালিক সালাহ উদ্দিন আহমেদের এসএ টেলিভিশন ও আওয়ামী ব্যবসায়ী হারুন-উর রশীদের এশিয়ান টেলিভিশন।
যে ৭টি এফএম রেডিওর অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বেগম ডলি ইকবালের একটি এফএম রেডিও, শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের গাংচিল মিডিয়া লিমিটেড, ব্যবসায়ী আবদুল আওয়ালের পিপলস রেডিও লিমিটেড, অভিনেত্রী সারা যাকেরের এশিয়াটিক রেডিও, ব্যবসায়ী হারুন আর রশিদের এশিয়ান রেডিও, সাইদুর আফতাবের সিটি এফএম এবং রফিক মোহাম্মদ ফখরুলের টিউন এফএম। এসব রেডিও যেমন আওয়ামী লীগের দলীয় লোকদের দেয়া হয়েছে, তেমিন ১৪টি কমিউনিট রেডিও একইভাবে পেয়েছে দলীয় লোকেরা।

টেলিকম খাতের ৭৮টি লাইসেন্সও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের
সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে গেছে টেলিকম খাতের সবচেয়ে লোভনীয় শাখার ৭৮টি লাইসেন্স। কেউ সরাসরি আবার কেউ নেপথ্যে থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন এই লাইসেন্স। মন্ত্রী, এমপি আর ক্ষমতাসীনদের দলীয় প্রভাবে লাইসেন্স নেয়ায় প্রক্রিয়াটি ছিল নানা রহস্যে ঘেরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোদ বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন) রেটিং পর্যন্ত মানা হয়নি। অমান্য করা হয়েছে নীতিমালার অনেক শর্ত। তালিকার উপরে থেকেও দলীয় হস্তক্ষেপের কারণে সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয়নি এই ব্যবসায়। অভিযোগ রয়েছে, লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবের পাশাপাশি ছিল মোটা অংকের টাকার খেলা।
লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে খোদ রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘সেনগুপ্ত টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড’ ছিল অন্যতম। নির্বাচনী হলফনামায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন মাত্র ৭ লাখ টাকা। আর ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে তার ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তের বেতন ছিল মাসে সর্বসাকুল্যে ৫০ হাজার টাকা। অথচ সৌমেন লাইসেন্স নিয়েছেন ৫ কোটি টাকা ফি দিয়ে। হঠাত্ কোনো ধরনের ব্যাংক লোন ছাড়াই এত টাকা লাইসেন্স ফি প্রদান করেছেন সৌমেন সেনগুপ্ত।
এর বাইরে ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন মন্ত্রী ও ১০ জন এমপি সরাসরি জড়িত রয়েছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে জানা গেছে। এদের মধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী লে. কর্নেল ফারুক খানের ভাই আজিজ খানের প্রতিষ্ঠান সামিট নিয়েছে কয়েকটি লাইসেন্স। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য সুনামগঞ্জের একজন এমপি, কেরানীগঞ্জ এলাকার একজন এমপি, ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একজন এমপি, আওয়ামী লীগের সাবেক একজন মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা বিটিআরসির কাছ থেকে আইজিএ, আইসিএক্স ও আইআইজি লাইসেন্স নিয়েছেন।
এছাড়া টেলিযোগাযোগ খাতের যত নতুন সেবা আসছে তার সবক’টিরই এক বা একাধিক লাইসেন্স পেয়েছে সামিট গ্রুপ। বহুল আলোচিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পেরও কনসালট্যান্ট নিয়োগে বাংলাদেশী অংশীদার সামিট। ৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের জন্য দেশি-বিদেশি ৩১টি কোম্পানি আবেদন করে। কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে সামিটকেই যোগ্য বলে বিবেচিত করে বিটিআরটি। এনটিটিএন, আইটিসি, আন্তর্জাতিক গ্যাটওয়ে আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজিসহ সবধরনের লাইসেন্স রয়েছে সামিটের হাতে।
বিটিআরসির ওয়াইম্যাক্স বরাদ্দেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। থ্রিজি নিলাম নিয়ে নাকটীয় পরিস্থিতির মধ্যে ৫ বছর আগের তরঙ্গ মূল্যে ওলো স্পেকট্রাম নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে ওয়াইম্যাক্স লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ হাজার কোটি টাকার ওয়াইম্যাক্স লাইসেন্স বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২১৫ কোটি টাকায়।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শুধু ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল (ভিওআইপি) খাত থেকে প্রতিদিন রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি টাকা। মাসে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকারও বেশি। ভিওআইপির কারণে উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর আন্তর্জাতিক কল।
টেলিকম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ছত্রছায়ায় একটি মহল অবৈধ ভিওআইপির বাণিজ্যের মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালীদের আশ্রিত হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। অথচ ভিওআইপি শনাক্ত করার সব আধুনিক সরঞ্জাম বিটিআরসির রয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেই অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হতো।

No comments:

Post a Comment