Monday 22 July 2013

নবীন এমপিরা বেপরোয়া

23 Jul, 2013
সংসদ সদস্যদের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে তাদের রাজনৈতিক দল। অভিযোগ উঠেছে, বিতর্কিত এসব কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আছেন প্রথমবার নির্বাচিত এমপিরা। এতে দলের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনি হ্রাস পাচ্ছে গ্রহণযোগ্যতাও। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে সংসদ সদস্যরা ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ক্ষমতার প্রভাব, খবরদারি, দলাদলি, তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবহেলা, নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, জাতীয় সংসদে অপ্রীতিকর বাক্যবিনিময়, ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা, সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করা, জঙ্গি কানেকশন, মাদক চোরাচালান, ন্যাম ভবনে আত্মীয়-স্বজনদের রাখা, টেন্ডার-ঠিকাদার নিয়োগ, ভূমি দখল, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা, নিয়োগ-তদবিরসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। এমনকি কাবিখা কার্যক্রমে অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে এমপিদের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের এমন ফিরিস্তি পেলেও দল থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে নবীন এমপিরা ক্রমেই আরও বেসামাল হয়ে উঠছেন। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রায় ১০০ নতুন নেতাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে দিনবদলের সংস্কৃতি চালু করেন। মনোনীত বেশিরভাগ তরুণ নেতা বিজয়ী হলেও দলের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও নতুন এমপিদের দাবি, ভবিষ্যতে মনোনয়ন কেড়ে নেওয়ার হীন উদ্দেশ্যেই এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। বিএনপিও গত জাতীয় নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নবীন রাজনীতিবিদকে দলীয় মনোনয়ন দেয়। তবে মনোনীত অধিকাংশই নির্বাচনে জয়ী হতে ব্যর্থ হন। আর যারা জয়ী হয়েছেন এবং সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের নেতিবাচক এবং জনবিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ডে এবং অসংলগ্ন আচরণ ‘ইমেজ সঙ্কটে’ ফেলে দিয়েছে বিএনপিকেও।
জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপিদের বিরুদ্ধেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ বেশি। সর্বশেষ ২০ জুলাই পটুয়াখালী-৩ আসনের সরকারদলীয় নবীন এমপি গোলাম মাওলা রনি দুই সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করে দেশ জুড়ে সমালোচিত হয়েছেন। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিতর্কিত এমপিদের সম্পর্কে ‘হাই কমান্ড’ অবহিত। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে ২০১২ সালের শুরুর দিকে সরকারের তিন বছর পার হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৭৫ এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ সংবলিত একটি তালিকা জমা দেয়। সেই তালিকায় বিতর্কিতদের অধিকাংশই প্রথমবার নির্বাচিত নবীন এমপি। পরে ওই অভিযোগের ভিত্তিতে দল থেকে অনেককে সতর্কও করা হয়। তবে শীর্ষ নেতাদের বারবার হুশিয়ারি সত্ত্বেও তারা বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছেন। বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, এ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য মহাজোট তথা আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে চড়া মাসুল দিতে হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সংসদীয় কমিটির সভায় বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী এমপিদের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও অনেককেই দেখছি ব্যক্তিগতভাবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন যা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। আওয়ামী লীগের যেসব এমপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গোলাম মাওলা রনির প্রসঙ্গে হানিফ বলেন, সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জাড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করলেও এমপি রনির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কেননা তিনি আওয়ামী লীগের কোনো স্তরের রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত নন।
গত সাড়ে চার বছরে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে যারা সবচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটকে বিব্রত করেছেন তারা হলেন, আবদুর রহমান বদি (কক্সবাজার-৪), গোলাম মওলা রনি (পটুয়াখালী-৩), নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন (ভোলা-৩), গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স (পাবনা-৫), মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (সুনামগঞ্জ-১), ইস্রাফিল আলম (নওগাঁ-৬), জুনায়েদ আহমেদ পলক (নাটোর-৩), আবদুর রহমান (ফরিদপুর-১), হোসাইন মকবুল শাহরিয়ার (রংপুর-১), শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), আবদুল ওদুদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা (ঢাকা-১৬), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ময়মনসিংহ-১০), সারাহ বেগম কবরী (নারায়ণগঞ্জ-৪), জাকির হোসেন (কুড়িগ্রাম-৪), আনোয়ার হোসাইন (পিরোজপুর-৩), মাহবুব আরা গিনি (গাইবান্ধা-২), এনামুল হক (রাজশাহী-৪), বেগম সানজিদা খানম (ঢাকা-৪), সোলাইমান হক জোয়ার্দার সেলুন (চুয়াডাঙ্গা-১), মো. আসলামুল হক (ঢাকা-১৪) এবং একরামুল করিম চৌধুরী (নোয়াখালী-৪)।
এছাড়াও শাহরিয়ার আলম (রাজশাহী-৬), বেগম সুলতানা তরুণ (কুষ্টিয়া-৪), জয়নাল আবেদিন (মেহেরপুর-১), আ ক ম বাহাউদ্দিন (কুমিল্লা-৬), অধ্যক্ষ শাহ আলম (পিরোজপুর-২), আবদুল্লাহ আল জ্যাকব (ভোলা-৪), হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫) প্রমুখের বিরুদ্ধেও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে।
পটুয়াখালী-৩ আসনের এমপি গোলাম মাওলা রনির বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, আচরণ আর নিজস্ব বাহিনীর দাপটে অতিষ্ঠ গলাচিপা-দশমিনার সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের এই এমপির বিএনপি-জামায়াত প্রীতির কারণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দলও। রনির শ্যালক মকবুল খান ও ছোট ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন ‘ভাইয়া বাহিনী’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো এলাকা। গলাচিপা-দশমিনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার, টিআর-কাবিখাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে ভাইয়া বাহিনী। এছাড়াও রনির বেফাঁস মন্তব্য প্রায়ই আওয়ামী লীগকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে। তরুণ এ সংসদ সদস্য যতটা না বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে তত্পর তার চেয়ে বেশি তত্পর নিজ দলের বিরুদ্ধে। দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের দুর্নীতি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করে হৈচৈ ফেলে দেন। প্রতিমন্ত্রীর সভামঞ্চ তিনি নিজেই ভাঙচুর করেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামলাতে রামদা হাতে তাকে দৌড় দিতেও দেখা গেছে। টকশোতে প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন রনি। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার এমপি রনিকে ‘বেইমান’ এবং ‘মীরজাফর’ বলে কঠোর ভাষায় ভর্ত্সনা ও সতর্ক করেছেন বলে জানা যায়।
এলাকায় সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও গত শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডে নিজ কার্যালয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনকে পিটিয়ে ফের আলোচনায় আসেন তিনি। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। এমপি রনিও এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছেন। এমপি রনির এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘটনায় দলের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। জানতে চাইলে গোলাম মাওলা রনি সকালের খবরকে বলেন, মকবুল খান আমার শ্যালক। তার নেতৃত্বে কোনো বাহিনী আছে বলে আমার জানা নেই। এছাড়া সর্বশেষ ঘটে যাওয়া ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে আমি জামিনে আছি।
কক্সবাজার-৪ আসনের সরকারদলীয় নবীন এমপি আবদুর রহমান বদির হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রিসাইডিং অফিসার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, শিক্ষক এমনকি মুক্তিযোদ্ধাও। বাদ যায়নি নিজদলীয় নেতাকর্মীরাও। যাকে অপছন্দ করেন তিনি তাকেই পেটান। রব উঠে যায় ‘তিনি শুধুই মারেন’। যাকে-তাকে পিটিয়ে বারবার পত্রিকার শিরোনাম হওয়া এই এমপির হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন, বন বিভাগের কর্মকর্তা হাজী মুজিবুল হক, টেকনাফের মুক্তিযোদ্ধা হাজী মোস্তফা, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট রাখাল মিত্র, শিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন চন্দ্র, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান এবং ম্যাজিস্ট্রেট আবদুর রহমান। সর্বশেষ বদির হামলার শিকার হয়েছেন টেকনাফের শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এমএ মনজুর। কেবল মারধরই নয়, টিআর, কাবিখা, উন্নয়ন প্রকল্প, টেন্ডার, নিয়োগ-বদলি সব জায়গায় বদির কথাই আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও তার নেতৃত্বে ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটই বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ কর্তা। বদির আপন দুই ভায়ের নামও রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাদক পাচারকারীদের গডফাদারের তালিকায়। জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া সাংসদ বদির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কাছে। দলীয় চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলার অভিযোগ তোলেন বদির বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন না করে অন্যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যারা করেছেন তাদেরকে আমি বাধা দিয়েছি। এতে অপরাধ কিছু দেখছি না। উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ জনগণের জন্য যেটা দরকার আমি সেটি করব। এজন্য আমার প্রাণ দিতে হলেও দেব।
ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও যুবলীগ নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন দেশ জুড়ে আলোচনায় আসেন যুবলীগ কর্মী ইব্রাহীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। এমপির গাড়িতে এবং তারই লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে হত্যা করা হয় ইব্রাহিমকে। এ ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নিহতের পরিবার এ ঘটনায় এমপি শাওনকে দায়ী করলেও সম্প্রতি হত্যা মামলা থেকে আসামি হিসেবে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে তাকে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে।
এছাড়া শাওনের বিরুদ্ধে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টেন্ডারও শাওনের নির্দেশ ছাড়া নড়ে না বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
২০১২ সালের ২৮ জানুয়ারি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে দেশ জুড়ে সমালোচিত হন রংপুর-১ আসনের ১৪ দলীয় জোটের তরুণ এমপি হোসাইন মকবুল শাহরিয়ার। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের ভাতিজা মকবুল সেই ঘটনায় নিজেও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গে এই সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষের প্রায় ৬০ নেতাকর্মী আহত হন।
পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স জেলা প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ভাঙচুর চালান। এ সময় পাবনা জেলা প্রশাসন কর্মবিরতি ঘোষণা করলে বেকায়দায় পড়ে সরকার। দেশ জুড়ে আলোচিত হয় বিষয়টি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্য প্রিন্সকে সতর্ক করে দেন। প্রিন্স দাবি করেছেন, তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার জন্য জেলা প্রশাসনকে আহ্বান করেছিলেন।
গত বছরের শেষ দিকে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বিরুদ্ধে জঙ্গি ও চরমপন্থীদের সহায়তার অভিযোগ ওঠে। সরকারের প্রভাবশালী এক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের এই এমপি জঙ্গি ও চরমপন্থীদের এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করা ও কারাবন্দিদের জামিনে ছাড়িয়ে নিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজশাহীর বাগমারা এলাকার সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পলাতক চরমপন্থী ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবির সদস্যরা এলাকায় ফিরতে শুরু করে। তিনি অর্থের বিনিময়ে জঙ্গি ও চরমপন্থীদের জামিনের ব্যবস্থা করে তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বাণিজ্য ও এমপিওভুক্তি, এলাকায় বিদ্যুত্ সংযোগের নামে টাকা আদায়, খাস ও সরকারি পুকুর, বিল, খাল ইত্যাদি টাকার বিনিময়ে পছন্দের লোকজনকে লিজ পাইয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করার অভিযোগও রয়েছে এনামুল হকের বিরুদ্ধে। তার প্রতিষ্ঠান এনা প্রপার্টিজের মাধ্যমে রাজশাহীতে সিটি সেন্টার নির্মাণ, কাটাখালীতে নর্দান পাওয়ার এবং বাগমারার চাইপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করেছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সে সময় ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, ‘এসব বানোয়াট কথা। জঙ্গি-চরমপন্থীরা কোর্টে গিয়ে জামিন নিয়ে আসে। সেখানে আমার কী করার আছে। আমরা বরং জঙ্গি-চরমপন্থী দমনে আন্দোলন করছি।’
নিজ দলের নেতাকর্মীদের দূরে রেখে বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে জলমহাল, পাথরমহাল, বালুমহাল, শুল্ক স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা) আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে। এমপির বড় ভাই মাসুদ মিয়া ‘ভাই বাহিনী’ গঠন করে ধর্মপাশার জয়শ্রী ইউনিয়নের শানবাড়ি বাজারঘাটে ধানচাল, কয়লা ও বালু-পাথরের নৌকা থেকে চাঁদাবাজি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমপির বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান, স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেনসহ দলীয় নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন। বক্তব্যের জন্য গত দু’দিন ধরে বারবার যোগাযোগ করা হলেও এমপি রতনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
চলতি বছরের মার্চে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেওয়ার অভিযোগে সমালোচিত হন নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ইস াফিল আলম। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের স্ত্রী অধ্যাপক আনোয়ারাকে সরিয়ে ইস াফিল আলম ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই ইস াফিলকে শোকজও করেছে। এ বিষয়ে ইস াফিল আলম জানান, ‘বৈধ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড গঠন হয়েছে। তাই অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দখলের বিষয়টি সঠিক নয়। ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য সদস্যরাও আছেন, এখানে আমি চেয়ারম্যান মাত্র।’
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল ওয়ান ইলেভেনের পর দলীয়ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়লে পুরো এলাকা ইস াফিলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিশেষ করে তার চার ভাই এলাকায় এক ধরনের সিন্ডিকেট বানিয়ে পুরো নওগাঁতে একক আধিপাত্য বিস্তার করেছেন।
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সরকারদলীয় সর্বকনিষ্ঠ এমপি জুনাইদ আহমেদ পলক নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন। নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া সম্পদের সঙ্গে সাড়ে চার বছরে পার্থক্য ঘটেছে বিস্তর। এছাড়াও পলকের হাতে গড়া ‘ফাইভ স্টার বাহিনী’ নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, পুকুর দখল, অপহরণ, বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যাসহ নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনে রেকর্ড গড়েছে। ২০০৯ সালের ৯ আগস্ট জেলা যুবলীগ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পলকের গড়া এই ফাইভ স্টার বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচার দাবি করে। আলোচিত ফাইভ স্টার বাহিনী বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় মহাসমাবেশে আংশ নিতে যাওয়া বিএনপির উত্তরাঞ্চলীয় নেতাকর্মীদের গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। হত্যা করে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেনকে। এছাড়া ফাইভ স্টার বাহিনীর হামলায় আহত হয় শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় অর্ধশতাধিক বাস-মাইক্রোবাস। এ ব্যাপারে মতামত জানতে এমপি জুনাইদ আহমেদ পলকের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ফরিদপুর-১ আসনের এমপি এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রহমান নিজ এলাকায় ‘বস’ বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এই বাহিনীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের খবর গত সাড়ে ৪ বছরে বহুবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া টিআর, কাবিখা, টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে এ অবস্থানে এসেছি। কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করিনি। আমার এলাকায় টিআর-কাবিখা নিয়েও কোনো লুটপাট হয়নি।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে গুলি করার হুমকি দিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের এমপি ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন। প্রকাশ্যে বন্দুক উঁচিয়ে এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি মেজর জিয়াকে হত্যা করেছি, আমি ফাঁসির আসামি, কাউকে ভয় পাই না।’ সে সময় ঘটনাটি অস্বীকার করে এমপি গিয়াসউদ্দিন বলেছিলেন, ‘এক কর্মকর্তা আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছেন, আমি মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছি, আমি তাকে হুমকি দিইনি।’ স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, এমপির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডারবাজিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের গায়ে হাত দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সাপে-নেউলে।
নির্বাচিত হওয়ার পর পায়ের স্যান্ডেল উঠিয়ে সবার সামনে শামীম ওসমানের দিকে তেড়ে গিয়ে আলোচনায় আসেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী। উদ্ধত এমন আচরণের জন্য বারবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন তিনি। সচিবালয়ের লিফটম্যান থেকে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত তার অমার্জিত আচরণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় কাউন্টার সন্ত্রাসীদের লালন করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ‘আমি গডফাদার নই। কারা সন্ত্রাসী লালন করে তা জাতি জানে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে মামলা হয়েছে। পৌরসভার মেয়র আতাউর রহমানসহ তিনজন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের আরেক এমপি জাকির হোসেন প্রকাশ্যে রৌমারী ভূমি অফিসের কর্মচারী মোশাররফ হোসেনকে মারধর করে আলোচনায় আসেন।
ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সানজিদা খানম জমি দখল, উন্নয়ন কাজে বাধা দিয়ে সমালোচিত হন। তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের মদদ দিয়ে থাকেন বলেও গণমাধ্যমে অভিযোগ এসেছে। বিভিন্ন সময়ে টেন্ডারবাজি, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলামের বিরুদ্ধেও।
কেবল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত তরুণ এমপিরাই নন, বিরোধী দলের নবীন এমপিরাও বেসামাল আচরণ করছেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচিত এমপি নিলোফার চৌধুরী মনি, শাম্মী আক্তার, রেহানা আক্তার রানু, সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়ার অসংলগ্ন বক্তব্য এবং বিতর্কিত মন্তব্যে প্রায়ই দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘চুদুরবুদুর’ ও ‘চুতমারানি’ শব্দ ব্যবহার করে তারা নতুন বিতর্কের জন্ম দেন। পিছিয়ে নেই সরকারদলীয় মহিলা এমপিরাও। নাজমা আক্তার, অপু উকিল এবং ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর অশালীন বক্তব্যে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে।

No comments:

Post a Comment