Sunday 17 March 2013

পুলিশী নির্যাতনে পা হারালো ২ জন ..সীমাহীন পুলিশী বর্বরতা


পুলিশের গুলিতে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলেন ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন ভুইয়া (৪৫) ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহাদ (২৩)। রাস্তা থেকে আটক করে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে নিয়ে হাত, পা ও চোখ বেঁধে নির্মমভাবে তাদের পায়ে গুলি চালায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ তাদের ভর্তি করে পঙ্গু হাসপাতালে। গুলি করার পর দীর্ঘ সময় থানায় ফেলে রাখায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা তাদের পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন। চিকিত্সকরা জানান, তাদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। গুলি চালিয়ে পঙ্গু করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ, এরপর তাদের নামে উল্টো মিথ্যা মামলাও দায়ের করে। 

এই নিয়ে বাংলা ভিশনের হৃদয়বিদারক ভিডিও দেখুন 




গতকাল সরেজমিনে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশ পাহারায় বেডে শুয়ে আছে আলমগীর ও ফাহাদ। আলমগীর আছেন হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সি নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে। দু’জন পুলিশ সার্বক্ষণিক তাকে পাহারা দিচ্ছে। আর ফাহাদ আছে নিচতলার আই ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বেডে। তাকেও পাহারা দিচ্ছে দু’জন পুলিশ। দু’জনই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তাদের সঙ্গে মিডিয়ার লোকজনের কথা বলতেও রয়েছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানান, উপরের নির্দেশ রয়েছে যাতে তারা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে না পারে। 
হাসপাতালের বাইরে থাকা আহত দুজনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা হতাশাগ্রস্ত। দুই পরিবারের সবাই তাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আহতদের পরিবারের দাবি, অবিলম্বে এ ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দেয়া হোক। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তারা। পাশাপাশি তারা সরকারের কাছে এ ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। 
পঙ্গু হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আলমগীরের আত্মীয় মো. রহুল জানান, আলমগীর রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। নীলক্ষেতে তার একটি কাগজের দোকান রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর এলাকায়। এতিহ্যবাহী ভুঁইয়া পরিবারের সন্তান তিনি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ছয়টায় ব্যক্তিগত কাজে মিরপুর যাওয়ার উদ্দেশে ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজের সামনে গেলে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। 
এ সময় পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে মিছিলকারীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে। তখন পুলিশ পিকেটার সন্দেহে আলমগীরকে আটক করে শেরেবাংলা নগর থানায় নিয়ে যায়। পরে থানার গোসলখানায় চোখ বেঁধে আলমগীরের বাম পায়ে গুলি করা হয়। পরে পুলিশ সদস্যরা তাকে জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিত্সকরা তার বাম পা কেটে ফেলে।
তিনি আরও জানান, আলমগীর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তার দুই সন্তান ধানমন্ডির একটি স্কুলে ও লেভেলে পড়াশোনা করে। এ ঘটনার পর পরিবারের মধ্যে চরম হতাশা নেমে এসেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার পর থানা পুলিশ নির্লজ্জের মতো তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করেছে। আলমগীরের শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ব্যক্তিগতভাবে দিশেহারা। তার দুটি সন্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। এ ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। এদিকে, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ফাহাদের কাছে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। 
চোখ মুছে ফিসফিস কণ্ঠে ফাহাদ জানায়, পান্থপথের ডলফিন রোডের একটি মেসে থাকত সে। গত ২৮ ফেবু্রয়ারি মেসে বুয়া না আসায় সে নাস্তা করার জন্য সকাল সাড়ে ছয়টায় ফার্মগেটের কুতুববাগের পাশের একটি হোটেলে নাস্তা করার জন্য যায়। এ সময় হরতালে সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলে মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুলি থেকে বাঁচার জন্য সে দৌড় দিলে পুুলিশ তাকে হরতালের পিকেটার সন্দেহে আটক করে থানায় নেয়। 
পরে সাদা পোশাকের পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে গোসলখানায় তাকে চোখ বেঁধে বাম পায়ে গুলি করে। এ সময় সে অচেতন হয়ে পড়ে। পরে থানা পুলিশ তাকে জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিত্সকরা তার বাম পা কেটে ফেলে। এ সময় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানায়। এ ঘটনার পর পুলিশ তার বিরুদ্ধে পুলিশি কাজে বাধা, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন ও গাড়ি ভাংচুরের তিনটি মিথ্যা বানেয়াট মামলা দায়ের করেছে। 
ব্যক্তিগতভাবে স্বপ্ন ছিল একজন আইনজীবী হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করবে সে, কিন্তু এ ঘটনার পর সে তার ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন। 
জানা গেছে, ফাহাদ ডেমরার সানারপাড়ে পরিবারের সঙ্গে থাকে। তার বাবার নাম মোফাজ্জল হোসেন ভুঁইয়া। ফাহাদ প্রাইভেট বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামে আইনের (সম্মান) ছাত্র। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। ফাহাদ এ ঘটনার অবিলম্বে তাকে গুলি বর্ষণকারী পুলিশের বিচার দাবি করে এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানেয়াট মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। 
আটক করে থানা কম্পাউন্ডে নিয়ে চোখ বেঁধে গুলি করার কারণ সম্পর্কে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি আবদুল মমিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। তিনি জানান, হরতালের সমর্থনে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পিকেটাররা একটি মিছিল বের করে। এ সময় পুলিশ প্রায় ৩০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। ওই গুলিতে দুইজন আহত হয়। আটকদের থানায় নিয়ে গিয়ে গুলি করাকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে তিনি মন্তব্য করেন।



No comments:

Post a Comment